আজ অনন্য সংগঠক, ব্লগার ও প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নিবেদিত কর্মী সাবরিনা সুলতানার জন্মদিন। তার সংগ্রামী ও বন্ধুর পথের সঙ্গী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তাই তার চিন্তা ও কর্ম জাতির কাছে তুলে ধরতে এবং তার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় এই নিবেদন।
বাংলাদেশ নাকি অমিত সম্ভাবনার দেশ। এখানকার মাটিতে নাকি লোহা পুতলে ফলে সোনা। এখানে নাকি কাশবনে ঘোরে জোনাকির দল। এখানে নাকি রয়েছে বিশ্বের দ্রুত ধনি তৈরির কারখানা। কিন্তু যে বৈষম্য ঘুচানোর স্বপ্নে বিভোর জাতি চেয়েছিল স্বাধিনতা। সেই স্বাধীন দেশের বৈষম্য মাপতে গেলে বাংলাদেশ দাড়াবে শুরুর কাতারে। তাহলে এতো বৈষম্যের বেরাজাল কাটাবে কে বা কারা। এর উত্তর আমরা পেয়েছি ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে। ‘তরুণ’ রাই হবে আমাদের গেমচেঞ্জার।
যুগে যুগে অঞ্চল, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ব্যতিরেকে দাড়িয়েছে কিছু না কিছু মানুষ। না তারা ইতিহাসের কোন মহানায়ক নয়। তারা নয় সোনালী হরফে লেখা কোন স্থাপনার নাম ফলকের ভারাক্রান্ত ঐতিহাসিক চরিত্র। তারা বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের ক্ষুদ্রতম বহিপ্রকাশ। তারা অনুচ্চারিত জনগোষ্ঠীর বিবেক। তারা হয়তো দখল করেনা কোন পুরষ্কার প্রদানকারীর অনুষ্ঠানের আসন। তবে থেকে যায় লোককথার খনা হয়ে। সেই মহানায়কদের কাউকে কাউকে আমরা স্মরণ করি বিশেষ বিশেষ দিনে। তাদের প্রয়ানের কয়েক বছর বা কয়েক দশক ধরে। তারপর কালের গর্ভে তারা বেশিরভাগ হারিয়ে যায়। রয়ে যায় মুক্তির মন্দিরের অশ্রুজলের সীমার বন্দি হয়ে।
তবে আজকে শ্রদ্ধা জানাবো একজন জীবন্ত কিংবদন্তিকে। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধের বাতিঘর সাবরিনা সুলতানা। যিনি লাক্ষো প্রতিবন্ধী মানুষের কন্ঠস্বর হিসেবে দাড়িয়েছেন, লিখছেন, কথা বলছেন নির্ধিদায়। কোন পুরষ্কার কিংবা বিদেশ ভ্রমণের হাতছানি তাকে আচ্ছন্ন করেনি। কোন তৈলাক্ত আসন তাকে টলাতে পারেনি তার অভীষ্ট লক্ষ থেকে। গুরুতর মাস্কুলার ডিস্ট্রোফি রোগের কারণে তিনি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেননি। কিন্তু তার অনুসন্ধিৎসু মন ও জীবনের প্রতি নির্মোহ আবেগ তাকে দিয়েছে এক নতুন দিনের দিশা।
আমরা অনেকে শরীর দিয়ে কাজ না করতে পারলেও মাথা দিয়ে পৃথীবির জন্য নিজেকে কাজে লাগানোর উদাহারন দিতে স্টিফেন হকিং এর নাম নিই। কিন্তু সাবরিনা সুলতানা কোন বিজ্ঞানী না হয়েও আমাদের কাছে স্টিফেন হকিং। অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ তাকে আড়ালে বাংলার হেলেন কেলার বলে ডাকে। অথচ তারা হয়তো তার প্রতিবন্ধিতার গুরুতর অবস্থা অণুধাবন নাও করতে পারেন। অন্তত জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের মতো করে তাকে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করেন। তার জন্ম যদি বাংলাদেশে না হয়ে পার্শ্ববর্তী অন্য কোন দেশে হতো তবে হয়তো তিনি এর চেয়ে বেশি মনোযোগের সুযোগ পেতেন। না তার নিজের প্রচারনার জন্য নয়। বরং হতাশ, অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন প্রতিবন্ধী মানুষের বুকে স্বপ্ন কী করে দেখাতে হয়, জাগিয়ে রাখতে হয় আশার প্রদীপ তার ফেরিওয়ালা হিসেবে। এই প্রসঙ্গে প্রাই মনে পড়ে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর একটি উক্তি, যে দেশে গুণের সমাদর নেই সে দেশে গুনি জন্মাবেনা। তবুও সাবরিনা সুলতানারা জন্মায়, বুনো ফুলের মতোই লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যায় তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞ।
সাবরিনা সুলতানার মতো একজন বনেদি পরিবারের মানুষ হয়েও যিনি কেবল তার নিজের সংগ্রাম ও তার বোনের অনাগত ভবিষ্যতের লড়ায়ের পথকে মসৃন করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে তার মতো লাক্ষো মানুষ এই দেশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবহেলা-বঞ্চনা ও বৈষম্যের যাতাকলে পিশে যাচ্ছে, অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের স্বপ্নদল। তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারলেননা। লিখে ফেললেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি(২০০৯)। যা তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করে, ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষদের ইনবক্স করে ও শেয়ার দিয়ে তার বোঝাপড়ায় প্রতিবন্ধী মানুষের অন্তরজ্বালা তুলে ধরেন।
আমরা বেশির ভাগ মানুষ দিবা স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করি। অনেকে জীবনে রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হয়ে অতিবিপ্লবি হওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু জীবনের কঠিন-কঠোর বাস্তবতায় ক’দিনেই বেশির ভা্গ মানুষ সেই ইউটোপিয়ান বা রোমান্টিক বিপ্লবের পথ ছেড়ে সুখী সুন্দর বা ভালো মানুষের নিরাধারা জীবনের পথে পা বাড়াই। বিলাসী জীবন, সংসার বা রোমান্টিক বিপ্লবী জীবনকে পাশকাটিয়ে তিনি কিন্তু পুরোদস্তুর একজন লেখক, সংগঠক ও অধিকার আদায়ের কর্মী হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
আমার দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি পেশাগত ও সাংগঠনিক জীবনে যেখানে দেখেছি বেশির ভাগ নেতা কেবল মুখ চালাতে বা কৌশল প্রণয়ন কিংবা কূটকৌশল বাস্তবায়নে ব্যাস্ত; সেখানে তিনি লেখা-লেখি করা ও লেখক তৈরি করা, নিজে প্রতিদিনের কাজ শিখে করা ও সহকর্মীদেরকে কাজ হাতে-কলমে শেখানো, সংগঠন বিষয়ে বোঝা-পড়া তৈরি করার পাশাপাশি জনগনকে সংগঠনের গুরুত্ব অনুধাবন করানো, নিজে সংগঠন তৈরি করা এবং মানুষের কাছে সংগঠন ছেড়ে দেয়া, নিজেকে উদার গ্রহণবাদে যুক্ত রেখে মানুষকে ওদারনৈতিক হওয়ার দীক্ষা দানের ব্রতী হতে।
তার হাতে প্রথম জন্মগ্রহনকারি প্রতিষ্ঠান বি-স্ক্যান। না দেখা, না চেনা একজন সমব্যাথী, সমঅভিজ্ঞ কিন্তু অগ্রজ সালমা মাহবুবকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ২০০৯ সালের জুলাই মাসে। সামান্য একটি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের একটি স্ভাধীন উচ্চারনের কেন্দ্রস্থলে দাড়িয়েছে বি-স্ক্যান। প্রথাগত এনজিও কর্মের বাইরে গিয়ে ভিন্ন চিন্তাধারার স্রোত তৈরি করে বি-স্ক্যান। যখন বেশির ভাগ মানুষ তার নিজের প্রতিবন্ধিতাকে অস্বীকার করতো বা লুকিয়ে রাখতো সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ে, সেখানে বি-স্খ্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্ম পরিচয়ের গ্লানির পরিবর্তে আত্ম গর্বের বিষয়টির প্রচার ও প্রসারে দারুন কাজ করে। আজকে যখন দেখি প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগঠন বা কর্মরত সংগঠনগুলোর মধ্যে বি-স্ক্যানের পেজ ও গ্রুপ সবচেয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় ও যেকোন বিষয়ে স্বোচ্চার তখন তার প্রয়াসের স্বার্থকতা বুঝতে বাকি থাকেনা। এছাড়া প্রবেশগম্যতা যে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বিশেষত গুরুতর প্রতিবন্ধী মানুষের বা সহায়ক উপকরণ ব্যাবহারকারিদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা তা লাগাতারভাবে জারি রাখতে পেরেছে বি-স্ক্যান। এটি এখন কেবল মৌখিক দাবি নয় বরং একটি প্রামান্য বাস্তবতা। অথচ তাদেরকে এজন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে, ‘ভাত, কাপরের ঠাই নাই প্রবেশগম্যতা নিয়ে বাড়াবাড়ি’। কিংবা ‘কর্মসংস্থান বা শিক্ষার কথার আগে প্রবেশগম্যতার দাবি কেমন করে ‘উঠে।
একজন ব্লগার হিসেবে তিনি যখন দেখলেন, দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের কন্ঠ, তথ্য পর্যাপ্ত স্থান পাচ্ছেনা, যাও পাচ্ছে তা আহা-উহুতে আক্রান্ত, সেখানে তিনি সিদ্ধান্ত নেন একটি পত্রিকা চালু করার। পত্রিকাটি আত্ম প্রচার বা নিজ সংগঠন প্রচারের পরিবর্তে দেশের আপামর প্রতিবন্ধী মানুষের কন্ঠস্বর তুলে আনার দিকে নজর দিয়ে দেশের বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে নিবন্ধ, প্রতিবেদন ছাপাতে থাকে। ফলে দ্রুতই পত্রিকাটি প্রতিবন্ধী মানুষসহ সংশ্লিষ্ট মহলে দারুন সাড়া ফেলে। “অপরাজেয়” ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি এক সময় তথাকথিত বড় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে মানুষ ক্ষেপানো পত্রিকা হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। অথচ আজ অর্থাভাবে এবং সাবরিনা সুলতানার শারীরিক সীমাবদ্ধতা বৃদ্ধির কারণে তা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
যখন দেখলেন দেশের প্রতিবন্ধী মানুষ অসংঘঠিত, তাদের সংগঠনগুলো কারো কারো কায়েমি স্বার্থের গোলামে পর্যবসিত হয়েছে, তখন তিনি যুক্ত হন আরেক দিকপাল রফিক জামানের উদ্দোগ প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠণের পরিষদ (পিএনএসপি)-তে। প্রায় চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে পিএনএসপি-এর নিউক্লিয়াসের চার জন সদস্যের একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে নিজের সংগঠন বি-স্ক্যানের জোয়ারের ভাটায় রেখে, অপরাজেয় পত্রিকার সংখ্যা সাময়িকভাবে বন্ধ করে হলেও পিএনএসপি-এর পালে হাওয়া দিতে প্রানান্তকর প্রচেষ্টা মনে করিয়ে দেয় তার সংগঠন, ব্যক্তিক, বা গোষ্ঠীগত সীমাবদ্ধতার উর্ধে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার। তাইতো মাত্র চার বছরেই পিএনএসপি হয়ে দাড়িয়েছিল প্রতিবন্ধী মানুসের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রস্থল। যদিও রফিক জামান এর তিরোধানের পর পিএনএসপি আন্দোলন আজ স্তিমিত, কিন্তু তার প্রভাব আজো প্রতিবন্ধী মানুষের ও তাদের সংগঠনের মাঝে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সাবরিনা সুলতানা ছিলেন সবচেয়ে বলিষ্ঠ নেপথ্য কুশিলব।
রফিক জামানের তিরোধানের পর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন চট্টগ্রামে একটি স্বাধীন জীবন-যাপন কেন্দ্র স্থাপনের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘কৃষ্টি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানে শ্রবণ প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, বাক প্রতিবন্দী ও গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মমূখী শিক্ষা, ব্রেইল এবং বাংলা ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা, সংগঠিত করা, সাংস্কৃতিক চর্চা, ব্রেইল মূদ্রণ, কৃষি কাজসহ প্রভৃতি নতুন নতুন ক্ষেত্রে কার্যক্রম বাড়িয়ে চলেছেন। তার এমন কাজের ফলে কিছু প্রতিবন্ধী মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। তবে এখনো অ-প্রথাগত কাজের প্রবণতার কারণে প্রথাগত প্রতিবন্ধী মানুষ বা তাদের তথাগত নেতৃত্বের সংদিগ্ধ দৃষ্টির কারণে সাধারণ প্রতিবন্ধী মানুষ বা তাদের নেতৃত্বের সাথে একটা প্রচ্ছন্ন দূরত্ব থেকেই গেছে। এছাড়াও তার ক্রমাগত শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিবন্ধী মানুসের সাথে নীবিড় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। কিন্তু তার শারীরিক গুরুতর অবস্থা উপলব্ধি না করতে পারার কারণে অনেকে তাকে ভুল বোঝার অবকাশ রয়ে যায়।
প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগঠিত করে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নাড়া দিয়ে আধমরা, ঘুমন্ত, অসচেতন প্রতিবন্ধী মানুসদেরকে চেতনায় ফিরিয়ে আনার ব্রত থেকে তিনি ২০১২ সালে ঢাকায় প্রবেশগম্য বাসের দাবিতে হুইলচ্যায়ার র্যালি, ২০১৪ সালে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিনিধিত্বের দাবিতে, ২০১৭ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদপ্তর দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন এবং ২০২২ সালে বাজেটে ৭ দফা দাবির বাস্তবায়নের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করেন। এছাড়া ২০২৩ সালে বাজেটে ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সারাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগঠিত করে জুন মাসে মাসব্যাপী এক গণআন্দোলনের ডাক দেন। ফলে ৪ জুন ২০২৩ ঢাকার শাহবাগে হাজার হাজার প্রতিবন্ধী মানুষ জরো হন। এছাড়াও ৯ ও ১৫ জুন শাহবাগে অবস্থান ও ১৫ জুন জেলায় জেলায় ডিসি অফিস ঘেরাও এবং ১৮ জুন দেশব্যাপী এলাকায় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। তার নেতৃত্বে প্রথম বারের মতো কোন সুনির্দিষ্ট সংগঠন বা মোর্চার ব্যানার ছাড়া এতো বড় গণজোয়ার অনুষ্ঠিত হয়। এটি সরকার ও তথাগত অনেক এনজিও কর্তাদের মাথা গুড়িয়ে দেয়। কোনরকম বিদেশী ডোনেশন ছাড়া বা বড় বড় সংগঠনের আর্থিক কোন সমর্থন ছাড়াই এতো বড় আন্দোলন সাধারন প্রতিবন্ধী মানুষের মাঝে সাড়া ফেলে। যদিও প্রথাগত সংগঠণগুলো সাবরিনা সুলতানা এবং গংকে সরকার বিরোধী দেখানোর প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু সাধারন প্রতিবন্ধী মানুষের আকাঙ্খার কাছে তা ফেল মেরে গেছে। সাবরিনা সুলতানা ৪ জুনের শাহবাগের সমাবেশে সকাল ৯টা থেকে সন্ধা ৭:৩০ মিনিট পর্যন্ত প্রায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা, অতিউচ্চ আদ্রতা মোকাবেলা করে শরীরের প্রতি এক দারুন অন্যায় করেন। ডাক্তার তাকে কিন্তু একদম রোদে, গরমে বা ধূলা থেকে দূরে থাকার বাধ্যবাধকতা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা না মানায় তার ফুসফুসে আবার এটাক হয়। ফলে তিনি ৭ জুনের প্রেস ক্লাবে প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত থাকতে পারলেও ৯ জুনের শাহবাগের সংহতি সমাবেশ, ১৫ জুনের শাহবাগে গণ জমায়েত ও সংসদ অভিমূখে পদযাত্রা এবং ১৮ জুনের পাড়ায় পাড়ায় বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিতে পারেনি। বরং ১০ তারিখে ক্রিটিকেল কেয়ার এ্যাম্বুলেন্সে চড়িয়ে তাকে কল্যানপুরের স্পেসালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি ৭ দিন আইসিউতে থাকতে হয়। ১৬ জুনে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান। তার পর দীর্ঘ দের মাস তার জমে-মানুষে টানা টানি চলে। সে এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তিনি ঢাকায় আসার পূর্বে উকিল দিয়ে একটি উইল করে আসেন। কারণ রফিক ভাই-এর অকাল মৃত্যুতে আমাদের এউত্তরাধিকার নির্ধারনে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। কৃষ্টি যেন টিকে থাকে, তার সম্পদ যাতে পরিবারের করায়ত্ব না হয় এমনটিই করতে চেয়েছেন। তিনি জানতেন এমন গরমে তার সমূহ জীবন নাশের মতো ঝুকি থাকতে পারে। তবুও তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের ঘুম ভাঙ্গাতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। অথচ কূচক্রী প্রতিবন্ধী মানুষেরা তাকে এবং আমাদেরকে সরকার বিরোধী বলতে ছাড়েনি। সংকীর্ণ রাজনীতি কতইনা নোংড়া!
২০২২ সালে ৭ দফা দাবির প্রথম দফা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা বাড়ানো হওয়ায় তথাগত শিক্ষিত প্রতিবন্ধী মানুষ বা তাদের নেতৃবৃন্দ ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের অনেক অনুচরদেরকে সামাজিক মাধ্যমে তা নিয়ে প্রোচারনা বৃদ্ধির প্রয়াস নিতে দেখা যায়। এটি অবিলম্বে হাটে মাড়া পড়ে। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রথাগত নেতৃবৃন্দ তাদের পুরোনো অবস্থান ছেড়ে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক সভায় ভাতা বৃদ্ধির দাবি তুলতে থাকেন। ফলে ২০২২ সালে চার বছর পর প্রতিবন্ধী মানুষদের ভাতা ১০০ টাকা বৃদ্ধি পায় যদিও তা প্রয়োজন বা আকাঙ্খার চেয়ে অনেক কম। বলা বাহুল্য, ২০২৩ সালের আন্দোলন অসংগঠিত, স্বল্প অর্থ ও লোকবল এবং যথাযথ সমন্বয়ের অভাব থাকলেও দেশের প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের বৈষম্য ও বঞ্চনার পক্ষে প্রথম বারের মতো কথা বলার কাউকে পেয়েছে বলে মনে করেছে। এছাড়াও গণমাধ্যমের ব্যাপক সাড়া সাধারন মানুষের মাঝে আমাদের বার্তা পৌছে দিতে সাহায্য করেছে। ফলে সাধারন মানুষ নিজেদের থেকে আরো সক্রিয় ও সচেতন হয়েছে। এতো এতো সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সাবরিনা সুলতানার বলিষ্ঠ ও দৃড় নেতৃত্ব ছাড়া এই আন্দোলন সংগঠিত হতো না। এটি নিশ্চই বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগ্রামের ইতিহাসের একটি অনন্য সাধারন ঘটনার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। সাবরিনা সুলতানা প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একজন বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। দেশে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহসন অনুষ্ঠানের পর সংরক্ষিত নারী সংসদ আসনের জন্য তফসিল ঘোষনার প্রস্তুতি শুরু হয়। তখন রাজশাহীর প্রতিবন্ধী মানুষের নেতা জনাব সোহেল রানা আমাকে ও সাবরিনা আপাকে ফোন করে এই নির্বাচনে প্রতিবন্ধী মানুষের পক্ষ থেকে সালমা আপাকে(সালমা মাহবুব, সাধারন সম্পাদক, পিএনএসপি ও বি-স্ক্যান) অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি হিজরা জনগোষ্ঠী থেকে অনুপ্রানিত হয়ে আমাদেরকে এই অনুরোধ করেন। পরে জানতে পারি তিনি সালমা আপাকে প্রথমে এই অনুরোধ করেন এবং তিনি তাতে রাজি হননি। পরে আমরা ১৭ জনের একটি গ্রুপ করে সেখানে প্রায় সাত দিন বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক, ভালো-মন্দ বিবেচনার পর সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের ভিত্তিতে নমিনেশন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও প্রথমে তা ১০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থির গ্রহণের সুযোগ থাকলেও পরে তা আওয়ামী লীগের দলীয় হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এতে সাবরিনা সুলতানার গুরুতর আপত্তি ছিল। গত ১২ বছর ধরে তার সাথে কাজ করার সময় এটিই ছিলো সবচেয়ে বেশি দ্বিধা বিভক্তকারি সিদ্ধান্ত। এটি কোন দল বা দলীয় সরকারের সুবিধার জন্য নয় বরং সরকারের ২০১৩ এবং ২০১৯ সালের দুটি সরকারি গ্যাজেটভুক্ত কর্ম পরিকল্পনায় প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিয়ার অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী মানুষের অনুরোধে গৃহিত একটি যৌথ সিদ্ধান্ত। কিন্তু সাবরিনা সুলতানা এটি কোন ভাবেই মেনেে নিতে পারেননি। তিনি কোন ভাবেই গত ফ্যসিস্ট সরকারের অংশ হতে চাননি। তার অনমনীয় ও আপোসহীন চরিত্রের পরিচয় মিলে এই প্রক্রিয়ার সময়। এটি পরবর্তি প্রজন্মের কাছে একটি অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
আমি কোন ব্যক্তি পূজার পক্ষে নই। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করে। সাবরিনা সুলতানার মতো প্রতিষ্ঠান কেবল প্রতিবন্ধী মানুষের কাছেই নয়, সাদারন মানুষের কাছেও এক উজ্জল অনুপ্রেনাদায়ী দৃষ্টান্ত।
সাবরিনা সুলতানাকে আমাদের স্বশ্রদ্ধ সালাম তার চরম শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তেও বীরোচিত, আপোশহীন, অননমনীয় ও অকুন্ঠ প্রয়াস জারি রাখার জন্য। তার অনুপ্রেরণা যেন বাতিঘর হয়ে কোটি মানুষের কাছে পৌছে যায়, এই প্রত্যাশা করি। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তার শান্তিময় ও কর্মমূখর দীর্ঘায়ু কামনা করছি। জয়হোক অদম্য লড়াকু মানুষের, জয় হোক প্রতিবন্ধী মানুষেরসংগ্রাম গাঁথার।
-লেখক, ইফতেখার মাহমুদ, সংগঠক ও উন্নয়ন কর্মী, Iftekhar.dpo@gmail.com
Leave a Reply